বিশ্বের আশ্চর্যতম জিনিস কিনতে ইচ্ছুক ছেলেটির গল্প
কোন একসময় এক দেশে এক বালক বসবাস করত। তার বাপ-মা এমন হতদরিদ্র ছিল যে, এক বেলা অন্ন জোগাড় করতে তারা হিমসিম খেয়ে যেত। অতিদীনহীন এক অস্তিত্ব কোন রকমে টিকিয়ে রাখতে চলতো তাদের নিরন্তর সংগ্রাম। একদিন যখন বালকটি ছুটোছুটি করে খেলাধুলা করছিল তখন সে একটা উজ্জ্বল গোলাকার জিনিস পড়ে পেল- এটা এক পয়সার একটা মুদ্রা। নিজের সৌভাগ্যজনক আবিস্কারে বালকটি যারপরনাই আনন্দিত। জিনিসটা হাতে নিয়ে এক ছুটে বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে দেখাল। গরীব ছিল বলে, এই এক পয়সা দর্শন এবং এমন পয়সার প্রকৃত মালিক হওয়ার অনুভূতিটা তাদের মনে নব দৃশ্যপটের জন্ম দিলো
বালকটির বাবা বললো, “এই পয়সা দিয়ে একটা ভেড়ী কিনলে কেমন হয়। ধীরে ধীরে এর পশম বিক্রী করে আমাদের করুণ ভাগ্যের উন্নতি করবোই করবো।”
অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রনায় এতক্ষণ কুঁকড়ে যাওয়া মা বললো, “আমাদের আগে পেটের প্রতি সুবিচার করতে হবে। সেজন্য এক পয়সার সয়াবিন ভাজা কিনে আমাদের পেট ঠান্ডা করতে হবে।” ছেলেটি বাবা মায়ের অভিপ্রায়ের কথা শুনল কিন্তু এ ব্যাপারে তারও বক্তব্য আছে বলে সে স্থির সিদ্ধান্ত নিল। তাই সে বললো, “না না আমি দুনিয়ার আশ্চর্যতম বস্তুটা কিনতে চাই, এটা বাদে আমি অন্য কিছু চাইনে।’’
এই বলে সে সোজা দোকানে চলে গিয়ে প্রত্যেক দোকানে যাচাই করতে শুরু করলো, “আপনাদের কাছে কি দুনিয়ার আশ্চর্যতম জিনিস আছে?” এমন অদ্ভুত জিজ্ঞাসায় দোকানদাররা তো হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কেউ তার কথা আগাগোড়া বুঝতে পারছে না, কাঙিক্ষত জিনিস দেয়া তো পরের কথা, সবাই চেঁচিয়ে উঠলো, “তুমি একটা হাঁদারাম কোথাকার, যে জিনিস কোথাও পাওয়া যায় না তা তোমাকে কে দিবে?”
নিজের প্রশ্নে হতাশ বালকটি বাড়ি ফেরার পথে এক দোকানে একটি পুঁচকে বানর বাঁধা দেখলো। তার মনে চিন্তা এলো বানরটাই হতে পারে পৃথিবীর সব চাইতে বিস্ময়কর জিনিস। এক পয়সার বিনিময়ে সে বানরটি নিয়ে গেল। নতুন জিনিসটা কেনায় বালকতো মহাখুশি। একদৌড়ে বাড়ি গিয়ে সে বাবা মাকে ক্ষুদে প্রানীটি দেখাল। প্রস্তাবিত ভেড়ী বা সয়াবিন ভাজার বদলে এহেন প্রাণী (যার উদ্ভট আচরণ পেট ভরানোর কোন কাজে লাগবে না) দেখে তারা ভীষণ মর্মাহত হলো। ফলে নির্বোধ ছেলেটিকে তারা আচ্ছামত বকাবাজি করলো, “নগ্ন ক্ষুধার যন্ত্রণায় যখন আমরা গোঙাচ্ছি, তখন এই বানরটি আমাদের কোন কাজে লাগবে, শুনি? আমাদের এই মহাপ্রাপ্ত এক পয়সা জলে গেল। তুই কি নির্বোধ হতচ্ছাড়ারে বাবা! ব্যথিতই কেবল ব্যথিতের ব্যথা বুঝে।” বালকটি কিন্তু নতশিরে মুখ বোজে পিতৃ- তিরস্কার সহ্য করলো।
সময় গড়িয়ে চললো বানর আশেপাশের বাড়ির ছাদ বাইতে শুরু করলো। লাফিয়ে এ ছাদ, ও ছাদ করতে করতে প্রতিদিন খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ত। একদিন ছাদের চূড়ায় খাদ্য সন্ধান কালে বানরটি এক দৈত্যের বাড়ির উপরে এসে হাজির হলো- যে কিনা প্রচুর স্বর্ণমুদ্রার মালিক। দৈত্য সেই সময় মুদ্রাগুলোতে দাগ লেগে যাবে অথবা ধুলো ময়লায় নিষ্প্রভ হয়ে যাবে এই ভয়ে ওগুলোকে সূর্যের আলোতে মেলে দেয়ার কাজে ব্যস্ত। মূল্যবান সম্পদের উপর নজর রাখতে রাখতে মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলো। ঘুমে দৈত্যর মাথা ঢলে পড়ছে দেখে বানরটি এই সুযোগে দু’চারটে স্বর্ণমুদ্রা চুরি করে নিলো। যতদ্রুত সম্ভব এক দৌড়ে ছুটে ওগুলো তার প্রভুর হাতে দিলো।
একটু পরে দৈত্যর ঝিমুনি ভাব চলে গেল। ঘুমে জড়ানো চোখ মেলে মহাবিস্ময়ে দেখল তার দু’চারটে স্বর্ণমুদ্রা উধাও হয়ে গেছে। সে আরো সতর্ক হলো। সম্ভাব্য চোরের সন্ধানে রত এবং বানরটিকে একদিন তার খুব কাছাকাছি দেখতে পেল। দানবীয় ক্রোধে গর্জে উঠলো, “তুইই তাহলে আমার স্বর্ণমুদ্রা চুরি করেছিস, তোকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। বিনা শাস্তিতে তুই ছাড়া পাবিনা। তোকে কঠিন মূল্য দিতে হবে।”এই বলে বানর পালানোর সময় পাওয়ার আগেই দৈত্য তাকে খপ করে ধরে ফেললো।
উপস্তিত বুদ্ধি সম্পন্ন বানর দৈত্যকে মামা বলে সম্বোধন করে বললো, “ একটা নির্দোষ জীবন হরণ করার জন্য এত তাড়াহুড়ো করোনা, তুমি না আমার মামা হও। মামা কি করে তার নিজের আদরের ভাগ্নের জীবন হরণ করতে পারে?” দৈত্য উত্তর করলো, “তুই স্বর্ণমুদ্রা চোর। তুই কী করে আমার ভাগ্নে হবি? তোর সব খেলা আমি এখনি সাঙ্গ করে দেব।” বানরটি কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি বলে দৈত্যর রাগের গতি নরম করার চেষ্টা করে যেতে লাগলো, “শোন মামা, তোমার ভাগ্নে যা বলে সেটা মন দিয়ে শোন। ভাগ্নে কি করে মামার সাথে মিথ্যাচারিতা করে? শোন মামা, শোন। নিঃসন্দেহে তুমি অঢেল সোনা রুপার মালিক । কিন্তু হায়! তোমার না আছে বউ, না আছে কোন বাচ্চা কাচ্চা । একবারও কি কখনো ভেবে দেখেছো তুমি মারা গেলে, যে সম্পদের জন্য তোমার এত অহংকার তা বেওয়ারিশ এবং অবহেলিত পড়ে রইবে। ওগুলো পড়বে অপরিচিত বেওয়ারিশ কোন লোকের হাতে। আর এটা হবে একটা দুঃখজনক ঘটনা যা ভাবতেও আমি শিহরিত হচ্ছি। তাই তোমাকে একটা সুন্দরী বালিকার সাথে বিয়ে দেয়ার মানসেই আমার এখানে আসা। এতে তুমি সুখি দাম্পত্য জীবনের স্বাদ পাবে। যুবতী রমনীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কের অনুভূতি দৈত্যের দানবীয় আবেগে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করলো। আর কথিত ভাগ্নে যা বললো বিশ্বাস করে তার উপর নির্ভর করলো।
দৈত্যের রাগ জল হয়ে গেল এবং সকৌতূহলে বললো, “ সত্যিই তাই?” এর তাকে নিজের ভাগ্নে বলে স্বীকার করে নিতে সে মহাখুশী।
বানরটি বললো, “একদম সত্যি মামা, তোমাকে মাত্র পনের দিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপর নতুন বউয়ের সাথে তোমার বিয়ে হবে।” নতুন বউয়ের আশায় আহ্লাদিত দৈত্য কথিত ভাগ্নের উপরে মুঠি শিথিল করে তাকে ছেড়ে দিলো। বানর ভালো করে ফন্দি এঁটে বাড়ি ফিরলো এবং তার প্রভুকে খড়ের মূর্তি প্রস্তুত করতে বললো যা বাইরের দিক থেকে সুন্দর ভাবে অংকিত কাগজ সাঁটা এবং এমন সুন্দর পোষাক পরিহিত যেন দেখতে যুবতী রমনী।
ছোট পোষা জন্তুর কাজে আনন্দে আত্মহারা বালকটি মহাখুশিতে তার অনুরোধে সম্মতি দিলো এবং সেই অনুসারে খড়ের মূর্তি জোগাড় করলো, রং মাখালো আর পোশাক পড়িয়ে যুবতী রমনী বানিয়ে ফেললো।
বানরের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিযে চললো। সে একদিন দৈত্যকে বললো, কয়েক দিনে তোমার জন্য একটা কনে বাছাই সম্পন্ন করেছি কিন্তু একটা সমস্যা হলো কি, বিবাহপূর্ব কিছু পোশাক আর গয়না তার জরুরী প্রয়োজন। এমতাবস্থায় তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারো?”
এহেন সুখের খবরে আনন্দে আত্মহারা দানব ভাবী বউ এর প্রতি অন্ধ আবেগ মথিত হয়ে বললো,- আরে ভাগ্নে বাহাদুর, এমন তুচ্ছ ব্যাপারে তুমি দুশ্চিন্তা কর কেন বলতো? আমার সোনা রুপা তো তোমার অধীন তবে যে ব্যাপারটা তুমি খেয়াল করবে তা হচ্ছে বিয়ের কাজটা যেন নির্ঝঞ্ঝাট এবং দ্রুত সম্পন্ন হয়।”
পরিকল্পনা সার্থকভাবে এগুচ্ছে দেখে বানরটা মুচকি হাসে। যত পারলো মূল্যবান জিনিস পত্র বয়ে নিয়ে সে প্রভুকে দিলো। এমনি করে বানরটির একদা উপবাস- ক্লিষ্ট মনিবদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল এবং অচিরেই অনেক ধন সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠলো। একদিন বানরটি তার প্রভুকে বললো, “মূর্তি বালিকাকে সোনা রুপা খচিত পোশাক পরিয়ে দামি দামি গয়না সজ্জিত করে দিন।” মনিবরা বানরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলো। বানরটি তখন ছুটে গেল দৈত্যের কাছে। গিয়ে বললো “মামা মনি, গয়না গড়তে যে একটু সোনা কমপড়ে গেল। তাই আর একটু সোনা রুপা দিয়ে যে আমাকে সাহায্য করতে হবে।”
ভাবি বধূর প্রতি উদারহস্ত দৈত্য এক থলি স্বর্ণরেনু দিয়ে দিলো – দৈত্যরা প্রচুর স্বর্ণ রেনুর অধিকারী বলে কথিত। মনিবের সম্পদ ভান্ডার নতুন করে ভরে তোলার জন্যই বানর স্বর্ণরেনুর থলি নিয়ে গেল। এর মধ্যে মনিবরা এমন করে মূর্তিটিকে পোশাক পরিয়েছে যেন সত্যিকারের কনে এবং টুকিচা, টায়ো, নায়াপুশিখা (নেপালী গয়না ) সোনার বালা, সোনার মল ইত্যাদি দামি অলংকারে সজ্জিত করলো।
সত্যি সত্যি মূর্তিটাকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর যুবতি কনের মতো দেখাচ্ছিলো। শুধু তার রক্ত মাংসেরই যা অভাব ছিল।
বানর সুপরিকল্পক হিসাবে প্রমাণিত হলো। ছুটে গেল দৈত্যর কাছে। বললো, “মামা মনি, মামা মনি, আগামী কালই তোমার বিয়ের দিন। তাই একটা জিনিস মনে রেখো। নব বধূকে যখন তোমার ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হবে তখন কিন্তু তুমি ঘরের মধ্যে চুপটি মেরে থাকবে, সবার চোখের একেবারে আড়ালে। কারণ এক মানবীর সাথে তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছে, আর কনের বাহক যারা তারাও মানব সন্তান বলে তোমার মত দৈত্যের মুখোমুখি হলে ভয়েই ওদের জান বেরিয়ে যাবে। তাহলে কিন্তু কনেকে সাথে সাথে নিয়ে চলে যাবে। তাই তুমি নিজেকে একটা কামড়ায় আটকিয়ে রাখবে যা আমি বাইরে থেকে তালা বন্ধ রাখবো। দ্বিতীয়ত তুমি কনের দেহ ছোঁবেনা, এমনকি তার কাছাকাছিও যাবেনা। কারণ তোমার চেহারা দেখে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।’ বধূকে ঘরে আনতে ব্যাকুল দৈত্য অক্ষরে অক্ষরে সব নির্দেশনা মেনে চলতে সানন্দে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পরের দিন অর্থাৎ বিয়ের দিন বানর মূর্তি কনেকে পালকি এর মধ্যে বসাল। চার বেহারা ওটা বয়ে নিয়ে চললো। কয়েকজন লোককে পালকির পিছনে পিছনে যাওয়ার জন্য পাঠানো হলো। পুরো দলটিকে মনে হচ্ছিল যেন বিয়ের মিছিল। বিয়ের মিছিল যাত্রা শুরু করা মাত্র বানর দৈত্যের কাছে ছুটে গেল। নির্ধারিত কক্ষে তাকে আটকিয়ে বাইরে থেকে আচ্ছামত দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। দৈত্যকে যে ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল তার বিপরীতে রাজকীয়ভাবে সজ্জিত এক বিশেষ ঘর কনের জন্য বরাদ্দ করা হলো। কনেকে মণি মুক্তা খচিত বিছানায় বসানো মাত্রই বাইরে থেকে দরজার তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। তখন সে দৈত্যকে যে ঘরে সাময়িক আবদ্ধ রাখা হয়েছিল সেখান থেকে বের করে কনের ঘরের বাইরে আনা হলো। দরজার মধ্যে ক্ষুদ্র ছিদ্রের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে নবগত বধূকে এক নজর দেখতে বলা হলো। বানর বলেই চললো, “মামা মামা, কোন রকম তড়িঘড়ি করোনা কিন্তু। ব্যস্ততা অপচয়েরই নামান্তর। শুধু নিজের চোখে একবার দেখে বল মেয়েটা পছন্দসই সুশ্রী কিনা। আপাতত দরজার গুপ্ত ছিদ্রের ভিতর দিয়ে দেখে নিজেকে তৃপ্ত কর। কোন ক্রমেই কিন্তু জোর করে ভিতরে ঢুকতে যেওনা তাহলে কিন্তু সকল পরিকল্পনা ব্যাহত হয়ে যাবে। নব বধূ কিন্তু অজ্ঞান হয়ে পড়বে, তীব্র ভয় পেয়ে মৃত্যু বরণ করবে, ভয় পেয়ে আহত হবে। তোমাকে অবশ্যই এক, দুই বছর নিজেকে সংযমী হয়ে চলতে হবে। এরপর স্বামী হিসাবে তোমাকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তার থেকে সে মুক্তি পাবে।”
বানরের নির্দেশ মতো দৈত্য গুপ্ত ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বিয়ের পোশাক পরে রাজকীয় খাটে শায়িত কনের সুন্দর অবয়ব দেখতে পেয়ে আনন্দে উন্মাদ হয়ে গেল এবং মনে মনে ভাবল, “ আমার প্রতি আনুকূল্যের কারণেই এমন সুন্দর কনে আমার ভাগ্যে জুটেছে। ধন্যবাদ আমার রাশিফলকে, ধন্যবাদ আমার স্নেহের ভাগ্নেকে ।” এবং নিজেকে কথিত ভাগ্নের প্রতি কৃতজ্ঞ ও ঋণী অনুভব করলো।
দৈত্যের এই খোশ মেজাজের সুযোগ নিয়ে বানর বললো, “এই যে আমার মামা মণি, এখন যে তোমাকে আমি নতুন কনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি তার জন্য কি তোমার এটা মানানসই এবং উপযুক্ত মনে হয়না যে তোমার এই আনন্দের ক্ষণে আমার প্রচুর পরিমাণে পুরস্কৃত হওয়া উচিত।”
নব বধূর আগমনে দৈত্য দ্বিধাহীন উত্তর দিলো, “এই যে ভাগ্নে বাহাদুর, চাওয়ার কি কোন দরকার আছে? আমার সব সম্পদ তো তোমার করতলগত। যতটা খুশি তুমি নেবে।”
আমাদের বানর আর বেশী কি চাবে? যতটা পারলো সে মূল্যবান সম্পদ বয়ে নিয়ে চললো তার প্রভুদের উদ্দেশ্যে যে ছোট ছেলেটার জন্য এই অপ্রত্যাশিত সম্পদ প্রাপ্তি যা তাদেরকে রাতারাতি ধনী বানিয়ে ফেললো সে বাবা মার কাছে বললো, “প্রিয় বাবা-মা, এই পুঁচকে বানরটা না থাকলে আমরা এই প্রাচুর্যের অধিকারী হতে পারতাম না। এই পৃথিবীতে এভাবে দেখা যায় অতি তুচ্ছ জিনিসও সবচেয়ে উপকারী বস্তু হতে পারে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নুড়ি পাথরও উপকারে আসতে পারে।” তার কথাগুলো খুবই সত্যি এবং বাবা মা ছেলের মন্তব্যে প্রশংসায় মাথা নত করে সম্মতি জানালো।
এর মধ্যে দৈত্য, নব পরিনীতা বধূর সঙ্গে কোন রকম ব্যক্তিগত সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে দাম্পত্য জীবনের সুখ আহরণে অনিয়ন্ত্রিত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সাধ মেটাতে সে শুধু দরজার ছোট ছিদ্রের ভেতর দিয়ে কনের সুন্দর দেহটা খাটে শায়িত দেখা ছাড়া অন্য কোন কিছু করতে পারতো না। কিন্তু দিন যতই গড়িয়ে চললো সে বউয়ের সাথে সরাসরি কথা বলার জ্বলন্ত বাসনা আর চেপে রাখতে পারলো না। একদিন ভাগ্নের কাছে ওয়াদা করা সমস্ত নৈতিক বাধা নিষেধ ছুঁড়ে ফেলার এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা নিল। দরজা ভেঙ্গে নব পরিণীতার ঘরে ঢুকলো দারুণ উৎকন্ঠায়, তার কাছে এগিয়ে গেলো। দৈত্য তারপর আলতো ভাবে বউয়ের দেহ স্পর্শ করলো কিন্তু হায়! যে ক্ষণে দৈত্যের আঙুল নব বধূর দেহ স্পর্শ করলো মূর্তিটা খাটের উপর থেকে আপাতত প্রাণহীন অবস্থায় মেঝের উপর পড়ে গেল। দৈত্যের তখন মনে হলো ভাগ্নের সতর্কবাণী এবং প্রতিশ্রুতি। মহাভয় এসে তার উপর ভর করলো ভাবতে সে শিউরে উঠলো যে নিজের বোকামি এবং অমার্জিত তাড়াহুড়ার কারণে এই মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল।
“হায় পোড়া কপাল! অভিশাপ নামুক তার মাথায়।” এমনি করে করুণ সন্তাপে আর্তনাদ করতে লাগলো। বউ হয়তো ভয় পেয়েই মারা গেল। শপথ পালন না করে আমি নির্বোধের মত কাজ করেছি।”সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে বানরটি এসে হাজির। সমস্ত ঘটনা তার পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটছে দেখে সে দারুণ ব্যথিত হবার ভণিতা করলো। তার চেহারায় ফুটে উঠলো বিষাদের করুণ ছায়া। সে বললো,“হায় আমার মামা, আমরা দুজনেই, পোড়া কপালে, আমার মামী আর ইহজগতে নেই। আহ, তুমি কি করছিলে গো?”
গভীর দুঃখে দৈত্য এতটাই বিহ্বল যে সে কপাল চাপড়াতে লাগলো। একটা কথাও না বলে নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেললো। সে শুধু কেঁদেই চললো আর তার কথিত ভাগ্নেও তার সাথে বিলাপ জুড়ে দিলো। তাদের দুঃখ কষ্ট পুরোপুরি ভাবে প্রকাশের পর বানরটি বললো, “মামা মণি, যা ঘটে গেছে তা নিয়ে আর দুঃখ করো না। কোন কান্না বা বিলাপ মৃত্যুকে পূনর্জীবন দান করতে পারবে না। এখন আমাদের শব যাত্রা করা উচিত। শবযাত্রার মিছিল যখন শ্মশানের দিকে অগ্রসর হলো তখন সে শুধু, “আমার প্রিয়তম স্ত্রী, আমার প্রিয়তম স্ত্রী,” বলে কাঁদতে থাকলো। কথিত মৃত দেহটা একটা একটা পাত্রের উপর রাখা হলো এবং তারপর যথাযোগ্য আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে শ্মশানের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। বেপরোয়া দৈত্য জোরে কাঁদতে কাঁদতে পিছন পিছন যেতে লাগলো এবং মাঝে মাঝে ছোট খাটো কামানের মতো গর্জে গর্জে উঠছিলো। আহা, আমার প্রিয়তম স্ত্রী, আমি কেমন করে তোমাকে হারানোর বিলাপ করবো? সাথে সাথে কথিত ভাগ্নে জোরে কেঁদে উঠলো।” হে আমার খড়-নির্মিত এবং কাগজ অংকিত মামি, ক্যামনে তোমাকে হারানোর বিলাপ করবো?” এভাবেই একটি পুঁচকে বানর এক সময়ে গভীর দুঃখে কষ্টে নিপতিত হতদরিদ্র পরিবারের ভাগ্যের দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, যে পরিবার পরবর্তীতে উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই সত্যই বানরটিকে বালকটি যেমনটা ভেবেছিলো পৃথিবীর সবচাইতে বিস্ময়কর জিনিস, বানরটি সেভাবেই নিজেকে প্রমাণ করলো।