আইয়ুব গীতি: লোকগানের সম্পদ
বই- আইয়ুব গীতি
লেখক – মো: আইয়ুব আলী
প্রচ্ছদ – ঢালী তমাল
প্রকাশক ও পরিবেশক – ছায়াবীথি
প্রকাশকাল – ২০২০ বই মেলা
মূল্য – ২৫০
ফোক গান বা লোক সঙ্গীত বাংলাদেশ তথা বাংলা গানের অন্যতম প্রাচীন ধারা। এটি মূলত বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। এখানেই গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ দুঃখের কথা ফুটে ওঠে। যে গান মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত, আঞ্চলিকতা ও প্রকৃতির প্রাধান্য বেশি, একক কিংবা সম্মিলিত কন্ঠে গীত হয় এবং যাতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ পায় তাকেই মূলত লোক সঙ্গীত বা ফোক গান বলি। এটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। এই ফোক গান বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় গানের ধারা যা লোকমুখে ব্যাপক গীত হয়। হালের ফোকগানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গীতিকার গীতিকবি আইয়ুব আলী। তার রচিত `আইয়ুব গীতি’ ফোক গানের প্রাণের রস ও রীতি মেনেই পরিপুষ্ট ফসল।
আইয়ুব আলীর গান আবহমান গ্রাম বাংলার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, গার্হস্থ্যের খুটিনাটি ঘিরেই। গানের ভাষায় নেই কাঠিন্য ও জটিল শব্দের বাহুল্য। নেই অতিকথন কিংবা অতিরঞ্জিত ভাবগীত। মানুষের সারল্যমাখা জীবনের কথা বলতেই যেন আইয়ুব আলীর কলম তুলে নেওয়া। এজন্যই কবি আসাদ উল্লাহ আইয়ুব গীতি বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন,
‘পল্লী জীবনের সর্বোপরি মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষের মুখের ভাষার গীতলতায় গানগুলো সৌন্দর্যের হীরক দ্যুতি ছড়িয়েছে।
’
সত্যিকার অর্থেই তাই। আইয়ুব আলীর গান সময়ের দাবি মেনেই লেখা। কারণ পল্লীর গান মানেই আমাদের শেকড়ের ঠিকানালোকের অনুভব। আমাদের মৃত্তিকা সংলগ্ন জীবনের প্রকাশ। মাটি ও মানুষের সম্পর্কের পুলকে আইয়ুব গীতিতে প্রকৃত জীবনমুখর ঘ্রাণের দেখা মিলে। আইয়ুব আলী অন্তরে ধারণ করেন আধ্যাত্মবাদ এবং মায়াবী জীবনবাদ। এরূপ চেতনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পল্লীর আনাচে-কানাচে। একারণেই আইয়ুব আলীর গানে প্রকাশ পায় গ্রাম জনপদের শাশ্বত প্রেম। অতি পরিচিত ভাষায় চির পরিচিত কথাটিই আরো সহজ সরল করে বলেন-
‘চান্দের আলো ঝলোমলো
বিলের জলে হাঁস
তোমার ঘরে ভাইঙ্গা পড়ে
হাসি বারো মাস।’
এভাবেই আইয়ুব আলীর প্রতিটি গানে প্রকৃতি, প্রেম ও জীবন একই সমান্তরালে প্রাণ পেয়েছে। তিনি আমাদের পরিচয় বা পূর্বপুরুষের সংগ্রামী জীবনের কথা বলেন। তার গানে বারবার স্পন্দিত হয় গ্রামীণ সংগ্রাম মুখর জীবন। এই প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা আইয়ুব আলী যখন বলেন,
‘পদ্মা পাড়ে বাড়ি আমার
ভাঙ্গা গড়া জীবন
জলে ভাসি চরে থাকি
কখন জানি মরণ।’
তখন আমাদের চোখে ভাসে এই জনপদের মানুষের লড়াকু সংগ্রামী জীবন। তাদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সুখ-দুঃখ-প্রেমের কথা জানান দেয়ার কাজটিই গীতিকার সুনিপূণ দক্ষতায় সম্পন্ন করেন।
`আইয়ুব গীতি’র গান, আমাদের জীবনের শোক-দুঃখ-বেদনা-আনন্দ খুশির ভেতর অবস্থান করেই হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উল্লাস এবং প্রেমানুভূতিকে জাগিয়ে রাখে সংশয়হীন। গানের ভাষায় স্বদেশের প্রতি টান ও মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায় সর্বাঙ্গে। অনুভব করা যায় এই প্রকৃতির জীবনবোধে উদ্ভাসিত অনুষঙ্গ। দেশের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা, তার ছোঁয়া পাওয়া যায় প্রতিটি গানে। আইয়ুব গীতির শক্তি এটিই। লোক সঙ্গীত হিসেবে এখানেই তার সার্থকতা। আবার তার শক্তির জায়গাই তার দুর্বলতা। কখনো কখনো আপনার মনে হতে পারে আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে হয়তো গ্রাম-বাংলার সেই সারল্য ও তরলতা নেই। গীতিকার হয়তো তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে তার বাইরে আইয়ুব আলী অতি সহজ-সরল গানের ভাষায় যে মায়ার ঘোর সৃষ্টি করেন, সেই মুগ্ধতার রেশ আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে নির্দ্বিধায়।
আইয়ুব আলী তার আইয়ুব গীতি'-তে যেই জগৎ জীবন নির্মাণ করেছেন, সেখানে ভাবুক মনের বিস্তার ঘটবে তা বলতে পারি দ্বিধাহীন। সুর ও সঙ্গীতের দ্বৈত পরশে এই গান আমাদের বিমোহিত করবে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় তা বলতে পারি নিঃসঙ্কোচে।
আইয়ুব গীতি’-র প্রচ্ছদ করেছেন দক্ষ শিল্পী তমাল ঢালী। গানের বিষয় ভাষা সেই প্রচ্ছদে রাঙা হয়েছে বহুগুণ। বলা যায় বইয়ের ভেতর-বাহির শিল্পের প্রশ্নে মানোত্তীর্ণ। গানের বই`আইয়ুব গীতি’ তার মৌলিকতা নিয়ে পাঠক ও শ্রোতামহলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বইটির শতভাগ মঙ্গল কামনা করছি।
শাহীন তাজ
mrshaheentaj@gmail.com